১৭০৪-ক

“হুকুব” বহুবচন, একবচনে “হুকবাহ” অর্থঃ দীর্ঘকাল, অনির্দিষ্ট কাল, এক যুগ, সত্তর বছর বা তদধিক সময় (মুফরাদাত, লেইন)। হযরত মূসা (আঃ)-এর ‘ইস্‌রা’ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ‘ইস্‌রা’র অনুরূপ ছিল (১৭ঃ২)—এই ভ্রমণ দৈহিক ছিল না, ইহা ছিল এক আধ্যাত্মিক বা রূহানী অবস্থা, যাহার মাধ্যমে হযরত মূসা (আঃ)-কে রক্ত-মাংসের দেহ হইতে বিস্মৃত করিয়া গভীর রূহানী মর্যাদায় উন্নীত করা হইয়াছিল। বাইবেল এবং কুরআন উভয়ই এই মতের সমর্থন করে। এই সমর্থনের কতকগুলি যুক্তি নিম্নে উল্লেখ করা হইলঃ (১) হযরত মূসা (আঃ)-এর জীবন সম্পর্কে খৃষ্টানগণ বাইবেলকে মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্য দলীলরূপে মানিয়া থাকে। কিন্তু বাইবেল এইরূপ অলৌকিক ও আশ্চর্যজনক ঘটনাটির উল্লেখ ছাড়িয়া দিয়াছে, এমনকি প্রসঙ্গক্রমে উচ্চারণ করিতেও ব্যর্থ হইয়াছে। (২) আল্লাহ্‌তা’লার নবীরূপে প্রত্যাদিষ্ট হওয়ার পূর্বে এবং পরেও মূসা (আঃ) মাত্র একটি সফরই করিয়াছিলেন এবং তাহা মিদিয়ানে। বাইবেল ও কুরআন উভয়ই এই ভ্রমণের প্রতি নির্দেশ করিয়াছে। উভয়ে এই বিষয়ে একমত যে, হযরত মূসা (আঃ) কেবল মিদিয়ানের দিকেই ভ্রমণ করিয়াছিলেন, কিন্তু বর্তমান এবং পরবর্তী আয়াতসমূহে যে সফর সম্পর্কে বর্ণনা রহিয়াছে তাহাতে উল্লেখিত হইয়াছে যে, এই সফরে মূসা (আঃ)-এর সাথে তাঁহার তরুণ সঙ্গী ছিল। (৩) পৃথিবীতে ‘মাজ্‌মায়াল বাহ্‌রায়্‌ন’ নামে পরিচিত কোন স্থান নাই। এই কথার অর্থ ‘দুই সমুদ্রের সংযোগস্থল’। মূসা (আঃ)-এর বাসস্থানের নিকটবর্তী এরূপ সংযোগ হইতেছে “বাবুল মান্দাব” যাহা ভারত মহাসাগর এবং লোহিত সাগরকে সংযুক্ত করিয়াছে, দার্দানেল প্রণালী যাহা ভূমধ্যসাগরকে মর্মর সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করিয়াছে এবং আল-বাহ্‌রায়্‌ন যেখানে আসিয়া পারস্য উপসাগর এবং ভারত মহাসাগর মিলিত হইয়াছে। এই সকল স্থানের মধ্যে একমাত্র দার্দানেল প্রণালীই এইরূপ একটি মিলন কেন্দ্র হওয়া সম্ভব ছিল, কারণ মিশর হইতে ইহার গতিপথের মধ্যে কেনান অবস্থিত, যাহা মূসা (আঃ)-এর গন্তব্য স্থান ছিল। কিন্তু তাঁহার জীবদ্দশায় তিনি সেখানে পৌঁছতে সক্ষম হন নাই। এই তিনটি কেন্দ্র বা অন্তরীপই হযরত মূসা (আঃ)-এর বসতি হইতে প্রায় এক হাজার মাইল দূরত্বে ছিল এবং সেই যুগে যাতায়াতের অসুবিধা এবং যানবাহনের অভাব বিবেচনা করিয়া বলা যায় যে, এইরূপ সুদীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করিতে তাহার বহু মাস সময় লাগিয়া যাওয়ার কথা এবং এমতাবস্থায় হযরত মূসা (আঃ)-এর পক্ষে তাঁহার শিষ্যদিগের আধ্যাত্মিক মঙ্গল মারাত্মকভাবে বিপন্ন না করিয়া এত দীর্ঘ কাল অনুপস্থিত থাকা সম্ভব ছিল না। বিশেষতঃ তাহাদের সম্পর্কে তাঁহার তিক্ত অভিজ্ঞতা হইয়াছিল—তাহাদেরকে ছাড়িয়া মাত্র চল্লিশ দিনের জন্য তুর পর্বতে থাকাকালীন সময়ে। ‘মাজ্‌মায়লি বাহ্‌রায়্‌ন’ শব্দের দ্বারা মনে হয় দুইটি বিধানের সংযোগ বা মিলন ক্ষেত্র বুঝাইতেছে। যথা—মূসায়ী শরীয়াত এবং ইসলামী শরীয়াতের সংযোগ বা মিলন ক্ষেত্র। এতদ্ব্যতীত অর্থাৎ এই বাহ্যিক প্রমাণ ছাড়াও অনেক অভ্যন্তরীণ প্রমাণ ৬১-৮৩ আয়াতসমূহে রহিয়াছে যদ্বারা প্রতিপন্ন হয় যে, মূসা (আঃ)-এর সফর দৈহিক বা বাহ্যিক ঘটনা ছিল না বরং আধ্যাত্মিক ছিলঃ (ক) রাজা কর্তৃক জবর দখল হইতে রক্ষা করার জন্য, ‘সে (সেই বুযুর্গ) নৌকার মধ্যে এক বড় ছিদ্র করিয়া দিলেন’ (আয়াত ৭২)।কিন্তু ছিদ্র করার পরে কি নৌকাটি চলাচলের উপযোগী ছিল না? উপযোগী থাকিলে রাজা উহা বাজেয়াপ্ত করিল না কেন? না থাকিলে উহা ডুবিয়া গেল না কেন? এই জড় জগতে কোন নৌকার তলাতে বিরাট ছিদ্র করিয়া দেওয়ার পরে ভাসমান থাকিতে পারে না। শুধু দিব্য-দর্শন বা কাশ্‌ফের জগতেই এইরূপ ব্যাপার সম্ভব। (খ) আল্লাহ্‌তা’লার কোন নবী দূরে থাক, সুস্থ মস্তিকের সচেতন ব্যক্তি, বৈধ কারণ ছাড়া, অপরের প্রাণ নাশ করিতে পারে না, যেমনটি সেই বুযূর্গ করিয়াছিলেন বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে (আয়াত-৭৫)। (গ) হযরত মূসা (আঃ)-এর মত আল্লাহ্‌তা’লার এক মহান নবী এবং উৎকৃষ্ট গুণবিশিষ্ট উদারচেতা ব্যক্তি সেই বুযুর্গের অপরাধ সাব্যস্ত করিলেন শুধু এই জন্য যে, তিনি পিতৃ-মাতৃহীন দরিদ্র বালক দুইটির ভাঙ্গা দেওয়াল মেরামতের জন্য মজুরী দাবী করিলেন না, কারণ শহরের লোকেরা তাঁহাদিগকে আপ্যায়ন করিতে অস্বীকৃতি জানাইয়াছিল? এতীম বালক দুইটি মূসা (আঃ)-এর অসন্তুষ্টি অর্জনের মত কি করিয়াছিল? বালকদ্বয় নহে বরং শহরের লোকেরাই তাহাদের আতিথেয়তা করিতে অস্বীকার করিয়াছিল। (ঘ) ইহা কল্পনাও করা যায় না যে, হযরত মূসা (আঃ)-এর মত আল্লাহ্‌তা’লার মহান নবীকে কষ্টকর দীর্ঘ ভ্রমণে বাহির হইতে হইয়াছিল শুধু মাত্র এক ‘আল্লাহ্‌র বান্দা’র সন্ধানে এবং তাঁহার নিকট এই শিক্ষা গ্রহণ করিবার জন্য যে, কেমন করিয়া নৌকার তলায় ছিদ্র করিতে হয় বা এক যুবককে হত্যা করিতে হয় অথবা কিরূপে দেওয়াল মেরামত করিয়া উহার জন্য পারিশ্রমিক গ্রহণ করিতে না হয়। এতদ্ব্যতীত বর্ণিত আছে যে, মহানবী (সাঃ) বলিয়াছেন যে, মূসা (আঃ) যদি নীরব থাকিতেন তাহা হইলে আল্লাহ্‌তা’লা গায়েবের বহু গোপন রহস্য আমাদের নিকট উদঘাটন করিয়া দিতেন। (বুখারী, কিতাবুত্ তফসীর)। কিন্তু অস্বাভাবিক কাজের মধ্যে গায়েবের কোনই রহস্য নাই যাহা “আল্লাহ্‌তা’লার বান্দা” করিয়াছিলেন বলিয়া কথিত হইয়াছে। মাওয়ারদির মতে মূসা (আঃ) যে ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলেন তিনি কোন মানুষ ছিলেন না, আল্লাহ্‌তা’লার ফিরিশ্‌তা ছিলেন (কাসীর)। এই সমস্ত ঘটনা একত্রিত করিয়া বিবেচনা করিলে অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী প্রমাণ মিলে যে, হযরত মূসা (আঃ)-এর সফর কাশ্‌ফ ছাড়া অন্য কিছু ছিল না, যাহার প্রকৃত মর্মার্থ জ্ঞাত হইবার জন্য তা’বিল বা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন। ৬১ আয়াতে ‘যুবক সঙ্গী’ শব্দটি ‘নূন’ এর পুত্র যশুয়ার প্রতি ইশারা হইতে পারে, কিন্তু ইহা হযরত ঈসা (আঃ)-এর প্রতি অধিকতর সঙ্গতভাবে প্রযোজ্য। হযরত ঈসা (আঃ)-ই ছিলেন হযরত মূসা (আঃ)-এর তরুণ সঙ্গী (অনুগামী) যিনি তাঁহার বিধানকে (শরীয়তকে) বিনষ্ট করার জন্য নহে বরং পূর্ণ করিতে আসিয়াছিলেন (মথি-৫ঃ১৭)। “আমি (যে পথে চলিতেছি সে পথে) চলায় যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে পৌঁছি” এই বাক্য প্রকাশ করিতেছে যে, মূসা (আঃ)-এর যুবক সঙ্গী তাঁহার ভ্রমণের প্রায় শেষ প্রান্তে আসিয়া তাঁহার সঙ্গে মিলিত হইয়াছিলেন। সফরের সূচনাতেই তিনি যুবকটিকে সঙ্গে লইয়াছিলেন বলিয়া মনে হয় না। মূসা (আঃ)-এর আবির্ভাবের ১৪শত বৎসর পরে ঈসা (আঃ)-এর আগমন। “অথবা আমি যুগ যুগ ধরিয়া চলিতে থাকিব”-এই শব্দগুলি ব্যক্ত করিতেছে যে, মূসায়ী শরীয়াত বহু শতাব্দী ব্যাপিয়া কার্যকর থাকিবে বা চালু থাকবে। মূসা (আঃ)-এর সময় হইতে আরম্ভ করিয়া মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আবির্ভাব পর্যন্ত, যখন মূসা (আঃ)-এর শরীয়াতের কার্যকারিতা শেষ হইয়া গেল, এই সময় কালের ব্যাপ্তী দুই হাজার বৎসরের উর্ধ্বে।