১৪৭

এই আয়াতটি সমস্ত সূরাটির বিষয়বস্তুর সারাংশ। অত্র আয়াতে উল্লেখিত বিষয়গুলি ক্রমানুসারে এই দীর্ঘ সূরাটিতে পর্যালোচনা করা হইয়াছে। অর্থাৎ প্রথমে আসিয়াছে নিদর্শনাবলী, তৎপর গ্রন্থ, তৎপর শরীয়াতের হিকমত, তৎপর জাতীয় উন্নতির পন্থাসমূহ (সূরার ভূমিকা দেখুন)।

এখানে লক্ষ্য করা যাইতে পারে যে, কুরআনে ইব্‌রাহীম (আঃ)-এর দুইটি প্রার্থনার উল্লেখ আছে। একটি ইস্‌হাকের বংশধরদের জন্য প্রার্থনা, অপরটি ইসমাঈলের বংশধরদের জন্য প্রার্থনা। প্রথম প্রার্থনাটি বর্ণিত হইয়াছে ২ঃ১২৫ আয়াতে এবং দ্বিতীয় প্রার্থনাটি বর্ণিত হইয়াছে আলোচ্য আয়াতে। ইস্‌হাকের বংশধরদের জন্য প্রার্থনাকালে, তিনি ঐ বংশে ইমাম বা সংস্কারক পাঠাইবার কথা বলিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহাদের কাজকর্ম বা মর্যাদা সম্বন্ধে কিছুই উল্লেখ করে নাই। তাহাতে বুঝা যায় ইস্‌হাক-বংশে সাধারণভাবে ধর্ম-সংস্কারকগণ আগমন করিবেন। কিন্তু এই আয়াতে আমরা দেখিতে পাই তিনি আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করিয়াছিলেন, তাঁহার বংশধরগণের মধ্যে এক মহানবী প্রেরণের জন্য। ইব্‌রাহীম (আঃ)-এর গৃহ হইতে উদ্ভূত দুইটি শাখার এই বাস্তব চিত্র, এই পার্থক্যের মধ্যেই নিহিত রহিয়াছে। ১২৫ নং আয়াত—১৩০ আয়াতে ইব্‌রাহীম (আঃ)-এর দুইটি পৃথক প্রার্থনার উল্লেখ করিয়া সূরাটি ইশারায় জানাইয়া দিতে চায় যে, ইব্‌রাহীম (আঃ) কেবল ইস্‌হাকের বংশধরদের উন্নতির জন্যই প্রার্থনা করেন নাই; বরং তাঁহার প্রথম পুত্র ইসমাঈলের বংশের উন্নতির জন্যও দোয়া করিয়াছিলেন। ইস্‌হাকের বংশধরেরা তাহাদের অসৎ কর্মের পরিণতিতে নবুওয়াত প্রাপ্তি হইতে বঞ্চিত হইয়া গেল। অতএব, এই আয়াতে প্রার্থিত ও প্রতিশ্রুত নবীর উত্থান ইব্‌রাহীম (আঃ)-এর বংশের অপর শাখা ইসমাঈলের বংশধর হইতে হওয়া ছাড়া কোন পথ নাই। এই প্রতিশ্রুত নবী যে ইসমাঈলীয় হইবেন, উহার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কুরআন অতিশয় যুক্তিযুক্ত ভাবে, ইব্‌রাহীম (আঃ) ও তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাঈল (আঃ) কর্তৃক কাবা-গৃহ নির্মাণ ও ইব্‌রাহীম (আঃ) কর্তৃক জ্যেষ্ঠপুত্রের বংশাবলীর উন্নতির জন্য প্রার্থনা, এই দুইটি বিষয় সাথে সাথেই উল্লেখ করিয়াছে। এই স্বাভাবিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সমালোচক খৃষ্টানেরা দুইটি প্রশ্ন তুলে (১) ইসমাঈল সম্বন্ধে এই ধরণের কোন প্রতিশ্রুতি আল্লাহ্‌তা’লা ইব্‌রাহীমকে দিয়াছিলেন বলিয়া বাইবেলে উল্লেখ নাই, (২) আল্লাহ্ ইব্‌রাহীম (আঃ)-কে প্রতিশ্রুতি দিয়া থাকিলেও, ইসলামের নবী যে ইসমাঈলের বংশধর উহার কোন প্রমাণ নাই।

প্রথম আপত্তির উত্তর এই যে, যদি ইসমাঈল সম্বন্ধে কোন ভবিষ্যদ্বাণী বা প্রতিশ্রুতি বাইবেলে লিপিবদ্ধ নাও থাকে, তাহা দ্বারা এই কথা নিশ্চয় বুঝায় না যে, এইরূপ ভবিষ্যদ্বাণী মোটেই করা হয় নাই। তাহাছাড়া, যদি বাইবেলের সাক্ষ্য দ্বারা ইস্‌হাক ও তাঁহার বংশধর সম্বন্ধীয় প্রতিশ্রুতি সত্য বলিয়া স্বীকৃতি পায়, তাহা হইলে কুরআনের সাক্ষ্য দ্বারা ইসমাঈল ও তাঁহার বংশধর সম্বন্ধীয় প্রতিশ্রুতি সত্য বলিয়া স্বীকৃতি পাইবে না কেন? কিন্তু আসলে, বাইবেল ইসমাঈল ও তাঁহার বংশধরকে ভুলে নাই। ইহাতে সুনিশ্চিত ভাবে ইসমাঈল ও তাঁহার বংশাবলীর উন্নতির কথা ঠিক সেইভাবে বলা হইয়াছে যেইভাবে ইস্‌হাক ও তাঁহার বংশাবলীর উন্নতির কথা বলা হইয়াছে (আদি পুস্তক- ১৬ঃ১০-১২; ১৭; ৬-১০; ১৭ঃ১৮-২০)। প্রকৃত সত্য ইহাই যে, ইসমাঈল সম্বন্ধে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইয়াছিল এবং ইস্‌হাক সম্বন্ধে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইয়াছিল, উভয় প্রতিশ্রুতিই মূলতঃ একই ধরণের, পার্থক্য নগণ্য। উভয়েই আল্লাহ্‌র আশীর্বাদপুষ্ট হইবেন; উভয়ে ফলপ্রসূ হইবেন; উভয়েরই বংশবৃদ্ধি বিরাটাকারে হইবে, উভয়েই বিরাট জাতিতে পরিণত হইবেন এবং উভয়ের বংশধরের মধ্যে রাজত্ব ও রাজ্য লাভ ঘটিবে। সুতরাং উভয় ভ্রাতা সম্পর্কে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির মাঝে যেহেতু মৌলিক কোন পার্থক্য নাই, অতএব ইস্‌হাকের বংশ যে সব পুরস্কারে ভূষিত হইবে, ইসমাঈলের বংশও সেইসব পুরস্কার লাভ করিবে, ইহা স্বীকার করিতেই হইবে। আর এই সত্য খ্যাতনামা জ্ঞানী খৃষ্টানগণও স্বীকার করিয়াছেন (দি স্কফিল্ড রেফারেন্স বাইবেল, পৃঃ ২৫)।

দ্বিতীয় আপত্তি, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যে ইসমাঈলের বংশধর এই কথার প্রমাণ নাই। এই আপত্তিও অবান্তর। কারণঃ- (১) যে কুরাইশ বংশে রসূলে করীম (সাঃ) জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহা পুরাকাল হইতেই ইসমাঈলের বংশধর বলিয়া দাবী করিয়া আসিতেছিল এবং সমগ্র আরবের লোক ইহা স্বীকার করিয়া আসিতেছিল। (২) কুরাইশ অথবা অন্যান্য গোত্র, যাহারা নিজেদেরকে ইসমাঈলের বংশধর বলিয়া দাবী করিত, তাহাদের এই দাবী মিথ্যা হইয়া থাকিলে, যাহারা সত্যিকার ইসমাঈল বংশের ছিল, তাহারা নিশ্চয় আপত্তি জানাইত। এমনকি, বংশ-ব্যাপারে বর্ণচূরি, আরবদেশে সে সময় খুন-খারাবীর কারণ হইয়া দাঁড়াইত; কিন্তু এ বিষয়ে কোন আপত্তি ও ঝগড়া-বিবাদ উপস্থিত হয় নাই। (৩) আদি পুস্তকের ১৭ঃ২০ শ্লোকে আল্লাহ্‌ প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন যে, তিনি ইসমাঈলকে বহু আশীর্বাদ দান করিবেন, তাহার বংশ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করিবেন, তাহাকে বিরাট জাতিতে পরিণত করিবেন এবং দ্বাদশ রাজার পিতা বানাইবেন। আরবের লোকেরাই যদি তাঁহার বংশধর না হইয়া থাকে, তাহা হইলে ঐ প্রতিশ্রুত জাতি কোথায়? আরবের ইসমাঈলীয় গোত্রগুলিই এই ক্ষেত্রে একমাত্র দাবীদার। (৪) আদিপুস্তকের ২১ঃ৮-১৪ শ্লোকের বর্ণনা মতে সারার সন্তুষ্টির জন্য হাগারকে (হাজেরা) বাড়ী ছাড়িতে হইয়াছিল। তাহাকে যদি হেজাজে লইয়া যাওয়া না হইয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার বংশধরেরা কোথায় আছে, আর তাহার নির্বাসন স্থলই বা কোথায়? (৫) আরবের ভৌগলিকরা সকলেই একমত যে হেজাজের পাহাড়গুলিই ফারান নামে অভিহিত হইত (মুজামুল বুলদান)। (৬) বাইবেলের মতে, ইসমাঈলের বংশধরেরা ‘হাবিলা হইতে শূর পর্যন্ত’ এলাকায় বসবাস করিত (আদিপুস্তক- ২৫ঃ১৮)। হাবিলা হইতে শূর পর্যন্ত শব্দগুলি দ্বারা আরবদেশের একপ্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বুঝায় (বিব সাইক্ প্রণেতা জে, ঈভি, লণ্ডন, ১৮৩২)। (৭) বাইবেল ইসমাঈলকে ‘উয়াইল্ড ম্যান’ বলিয়াছে (আদিপুস্তক ১৬ঃ১২) এখানে ‘উয়াইল্ড ম্যান’ শব্দটির অর্থ গৃহবাসী বা গৃহাবদ্ধ নয় এমন মানুষ স্বাধীনভাবে বিচরণকারী মানুষ, বা মরুচারী লোক। আরবী শব্দটির অর্থও তাহাই। (৮) এমন কি পল পর্যন্ত স্বীকার করিয়াছেন যে, হাগার (হাজেরা)-এর সাথে আরব দেশের সম্পর্ক আছে (গালাতীয়- ৪ঃ২৫)। (৯) কেদার ইসমাঈলের পুত্রদের একজন ছিলেন এবং ইহা স্বীকার করা হইয়া থাকে যে, তাহার বংশধরেরা আরবদেশের দক্ষিণাংশে বসবাস করিত (বিব, সাইক, লণ্ডন, ১৮৬২)।(১০) প্রফেসার সি.সি. টরী বলেন, “আরবেরা হিব্রু ঐতিহ্য ও কাহিনী অনুযায়ী ইসমাঈল বংশীয়। …….. ঐ বারজন যুবরাজ (আদিপুস্তক- ১৭ঃ২০) যাহাদের নাম পরে (আদিপুস্তক- ২৫ঃ১৩ এফ এফতে উল্লেখিত হইয়াছে, আরবের গোত্র বা জেলাগুলির প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যাহাদের মধ্যে কেদার, দুমা (দুমাতুল জান্দাল) এবং তেইমা সুপ্রসিদ্ধ।” আরব দেশের লোকেরা এক মহান জাতি (জিউইশ ফাউণ্ডেশন অব ইসলাম, পৃঃ ৮৩)। “শারীরিক গঠন-প্রকৃতি, ভাষা, স্থানীয় কৃষ্টি-কাহিনী ও বাইবেলের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে, প্রধানতঃ ও সত্তাগত ভাবে ইসমাঈলীয়” (সাইক্লোপিডিয়া অব বিবিকেল লিটারেচার, নিউ ইয়র্ক, পৃঃ ৬৮৫)। (১১) “আমরা সর্বদাই হাগারের (হাজেরার) পুত্রগণের অন্যায় মনোবৃত্তিকে দোষারোপ করিতে থাকিব, বিশেষ করিয়া কুরাইশগণকে, কেননা তাহারা জানোয়ারের মত” (লীড্স্ ফ্রম থ্রি এনসিয়েন্ট কুরানস, সম্পাদক রেভারেণ্ড মিন্‌গানা ডি.ডি, ইনট্রো ১৩শ)।