‘সামূদ’ শব্দটি আরবী হওয়াতে ইহাই প্রতীয়মান হয় যে, এই জাতি আরব বংশোদ্ভূত এবং আরব উপজাতি। ইহা এক অসার যুক্তি যে, সালেহ কোন বিদেশী নামের অনুবাদ। কারণ কুরআন করীম সকল বিদেশী নামসমূহ অনুবাদ না করিয়া অপরিবর্তিতভাবে গ্রহণ করিয়াছে, যেমন মূসা (Moses), হারূন (Aaron), ইউনুস (Jonah) এবং যাকারিয়া (Zachariah)। ‘সামূদ’ ছিল ‘আদ’ জাতির উত্তরাধিকারী (৭ঃ৭৫) সূতরাং আদ্ও আরবীয়দের মধ্যেই একজাতি। আবার ‘আদ’ জাতিও নূহের (আঃ) জাতির উত্তরাধিকারী। ইহাতেই প্রমাণিত হয় যে, নূহ (আঃ) ও একজন আরব ছিলেন। অবশ্য নূহ (আঃ)-এর আবির্ভাব হইয়াছিল মেসোপটেমিয়াতে এবং এই অঞ্চল পুরাকালে আরবদের দ্বারা শাসিত ছিল। গ্রীক ঐতিহাসিকগণের উপস্থাপনানুযায়ী ‘সামূদ’ জাতির অবস্থান খৃষ্টিয় যুগের কিছু পূর্বের কোন এক সময়ে ছিল। তাহাদের মতে হিজ্র বা আগ্রা এই জাতির বাসস্থান। তাহারা ইহাদের সামূদোন’ নামে অভিহিত করিত, এবং হিজর-এর নিকটবর্তী একটি স্থানের উল্লেখ করে যাহাকে আরবের লোকেরা ‘ফাজ্জ আন্-নাকাহ্’ বলিয়া থাকে। টলেমি (Ptolemy-১৪০ খৃষ্টপূর্ব) বলেনঃ হিজ্র-এর নিকটে ‘বাদানাতা’ নামে এক স্থান আছে। ‘ফুতুহুশ শামের’ প্রণেতা আবু ইসমাঈল বলেনঃ সামূদ জাতি বোস্রা (সিরিয়া) এবং এডেন-এর নিকটবর্তী অঞ্চলে বিস্তার লাভ করিয়াছিল এবং তথায় তাহারা শাসন করিত। সম্ভবতঃ তাহারা উত্তরদিকে দেশান্তরিত হইতেছিল। আল-হিজ্র (যাহা মাদাইনে সালেহ্ নামেও পরিচিত), বোধ হয় এই জাতির রাজধানী ছিল যাহা মদীনা এবং তাবুকের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এই হিজ্র সেই উপত্যকার অন্তর্গত যাহাকে ‘ওয়াদি কুরা’ বলা হয়। ইহা প্রণিধানযোগ্য বিষয় যে, কুরআন করীমের বহুস্থানে হূদ্ এবং সালেহ্ নবী (আঃ)-এর বর্ণনা পাওয়া যায়, এবং প্রত্যেক স্থানে একই নিয়মের ক্রম-পদ্ধতি পরিলক্ষিত হয়, যেমন হুদ্ (আঃ)-এর ঘটনাবলী প্রথমে এবং সালেহ (আঃ)-এর কথা পরে বর্ণিত হইয়াছে, যাহা প্রকৃতই কালানুক্রমিক বিন্যাস। ইহাতে এই কথাহ প্রমাণিত হয় যে, কুরআন করীম নির্ভুলভাবে ও সঠিক ক্রমবিন্যস্ত ঐতিহাসিক ধারায় ইতিহাসের প্রকৃত ঘটনাবলী তুলিয়া ধরিয়াছে, যাহা কালের বসতির তলে হারাইয়া গিয়াছিল এবং প্রচ্ছন্নতার মধ্যে আচ্ছাদিত ছিল। কোন কোন লেখকের মতে ‘সামূদ’ হইল ‘আদ এ সানীয়া’ অর্থাৎ দ্বিতীয় আদের আর একটি নাম মাত্র। আবার অন্যান্যদের মতে দ্বিতীয় ‘আদ’-এর পরে তাহাদের আবির্ভাব। সামূদ জাতি পাহাড়ে-প্রান্তরে রাজত্ব করিত (৭ঃ৭৫) এবং সেই দেশ প্রচুর ঝর্ণা ও স্রোতস্বিনীময় ও বাগবাগিচাপুর্ণ ছিল। সেখানে অতি চমৎকার ও উত্তম জাতীয় খর্জুর বৃক্ষ উৎপন্ন হইত। তাহারা জমিতে কৃষি কার্য করিয়া শস্যাদি উৎপাদন করিত (২৬ঃ১৮৮—১৪৯)। কুরআন করীমের এই বর্ণনা সমর্থিত হয় প্রত্মতাত্ত্বিক প্রস্তর ফলকে উৎকীর্ণলিপি দ্বারা। এগুলির পাঠোদ্ধার করিয়াছিল মুসলমানগণ আমীর মুয়াবিয়ার রাজত্বকালে। মনে হয় সালেহ্ নবীর যুগের পর এই জাতির পতন আরম্ভ হয়, কারণ তাঁহার সময়ের মাত্র কয়েক শতাব্দী ব্যবধানেই বিজয়ী জাতিগুলির মধ্যে তাহাদের সম্বন্ধে উল্লেখ পাওয়া যায় না। আরব দেশ কোন এক এসিরিয়ান বাদশা কর্তৃক আক্রান্ত হইয়াছিল (৭২২-৭০৫ খৃঃ পূর্ব) এবং পরাজিত উপজাতিগুলির ফিরিস্তির মধ্যে সামূদ নামের উল্লেখ পাওয়া যায় খুদিত এক শীলালিপিতে—ইহা সেই রাজা উহার বিজয়ের গৌরবময় স্মৃতি রক্ষার্থে খোদাই করাইয়াছিল। গ্রীক ঐতিহাসিকগণের মধ্যে ডাইডোরাস (৮০ খৃঃপূঃ), প্লিনী (৭৯খৃঃপূঃ) এবং টলেমী তাহাদের রচিত পুস্তকে সামূদ জাতির সম্বন্ধে উল্লেখ করিয়াছেন। রোম সম্রাট জাস্টনিয়ান (JUSTINAN) যখন আরবদেশ আক্রমণ করিয়াছিল তখন তাহার সৈন্য বাহিনীতে তিনশত সামূদী সৈন্য অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বেই এই উপজাতির চিহ্ন সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছিল (দি লারজার এডিশন অব দি কমেন্টারী’ দ্রষ্টব্য)।