বাক্যাংশটির অর্থ এই হইতে পারেঃ এইরূপ ভাবে আল্লাহ্তা’লা ঈসা (আঃ)-কে মৃতপ্রায়, অবস্থা হইতে নবজীবন দান করিলেন। ‘মাওতা’ শব্দ ‘মাইয়েৎ’-এর বহুবচন। মাইয়েৎ অর্থ মৃতপ্রায়, মৃতের মত, মৃতবৎ (লেইন)। এখানে ‘মাওতা’ শব্দটিকে এই অর্থেই গ্রহণ করিতে হইবে, কেননা, কুরআনের বর্ণনানুসারে সত্যিকার মৃতরা পৃথিবীতে পুনর্জীবিত হয় না (২১ঃ৯৬, ২৩ঃ১০১)। সম্পূর্ণ আয়াতটির অনুবাদ এইরূপ ভাবেও করা যাইতে পারে— তখন আমরা বলিলাম, তাহাকে (হত্যাকারীকে) তাহার অপরাধের অংশ বিশেষের জন্য আঘাত কর। এই ভাবেই আল্লাহ্ মৃতকে জীবিত করেন এবং তোমাদিগকে তাঁহার নিদর্শন দেখাইয়া থাকেন যাহাতে তোমরা বুঝিতে পার। এই অনুবাদের প্রেক্ষিতে, পূর্ববর্তী আয়াতকে মিলাইয়া বিষয়টি এইরূপ দাঁড়াইবেঃ মহানবী(সাঃ) মদীনায় পৌঁছিয়া ইহুদীদের সহিত একটি শান্তি-চুক্তি সম্পাদন করিয়া পারস্পরিক সৎ প্রতিবেশী-সুলভ সম্পর্কের মাঝে থাকিবার ব্যবস্থা করিলেন। কিন্তু ইসলামের ক্রমোন্নতি ও কৃতকার্যতা ধীরে ধীরে ইহুদীদের ঈর্ষার কারণ হইয়া উঠিল। তাহাদের নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করিয়া ইহুদী নেতা কাব-বিন-আশরাফ অগ্রবর্তী ভূমিকায় অবতীর্ণ হইয়া ইহুদীদিগকে মুসলমানের বিরুদ্ধে গোপনে গোপনে ক্ষেপাইয়া তুলিল। বদরের যুদ্ধের অল্পদিন পরেই একজন মুসলমান মহিলা এক ইহুদীর দোকানে কিছু কেনা-কাটার জন্য গেলে, দোকানদার তাহার সহিত অপমানসূচক ব্যবহার করে। নিরীহ ভদ্র মহিলা সাহায্যের জন্য চিৎকার করিতে থাকিলে, নিকটবর্তী স্থান হইতে একজন মুসলমান তাহার সাহায্যের জন্য দৌড়িয়া আসে। ধ্বস্তা-ধ্বস্তির মাঝে দোকানদারের মৃত্যু হইলে, ইহুদীরা সদল বলে ছুটিয়া আসিয়া ঐ মুসলমানকেও মারিয়া ফেলে। ঘটনার তদন্ত শুরু হইলে দুষ্কৃতকারীদের কেহই দোষ স্বীকার করিল না, একে-অন্যের দোষ ঢাকিয়া রাখিল। কেহ কেহ অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাইবার চেষ্টাও চালাইল। এই হত্যা একটি আচম্কা ঘটনা হইলেও তেমন কিছু হইত না। কিন্তু ইহুদীদের দুষ্কর্ম ও দুর্ব্যবহার দিন দিন বাড়িতে লাগিল। মুসলমানের প্রতি অপমানজনক ব্যবহার এবং উস্কানীমূলক আচরণ ইহুদীদের নিত্য নৈমিত্তিক কাজে পরিণত হইল। তাহারা সর্বদাই গণ্ডগোল বাধাইবার চেষ্টায় রত থাকিত (হিশাম)। এইসব ষড়যন্ত্র ও গণ্ডগোল পাকাইবার মূল হোতা ছিল রসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর প্রধান শত্রু কাব-বিন-আশরাফ। সে মক্কাতে গিয়া, আপন বাগ্মীতা দ্বারা মক্কার নেতৃবৃন্দকেও এমনভাবে উত্তেজিত করে যে, বদর-যুদ্ধের শোচনীয় পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণকল্পে কুরাইশগণ কা’বা গৃহের আবরণ বা গিলাফ ছুইয়া প্রতিজ্ঞা করিল, ইসলাম ধর্ম ও এই ধর্মের প্রবর্তককে ধ্বংস না করিয়া তাহারা শান্তিতে নিদ্রা যাইবে না। কাব মহানবীর (সাঃ) পরিবারের মহিলাগণের নামে দুর্নাম রটনা করিয়া ঘৃণ্য পন্থায় বহু কবিতা প্রচার করাইবারও ব্যবস্থা করিল। তাই পুনঃ পুনঃ বিশ্বাস-ঘাতকতা ও দুষ্কৃতির জন্য এবং সর্বোপরি একজন নিরপরাধ মুসলমানকে হত্যার শাস্তি-স্বরূপ তাহাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হইল। এই শাস্তি হইল আংশিক শাস্তি; অবশিষ্ট শাস্তিতো পরকালের জন্য রহিলই। ‘কাতালতুম’ ক্রিয়াপদটি বহুবচনে ব্যবহার করিয়া, কুরআন মদীনার সকল ইহুদী গোষ্ঠীকেই ঐ হত্যার জন্য দায়ী করিয়াছে। তবে মৃত্যুদণ্ড দিবার সময় কেবল মাত্র দুষ্ট দলপতিকে বাছিয়া চিহ্নিত করা হইল, এখানে ‘আয্রিবুহু’ র ‘হু’ সর্বনামটি কাবকে নির্দেশ করিতেছে। আয়াতটির অর্থ উপরোক্তভাবে ধরিয়া লইলে, “এইভাবে আল্লাহ্ মৃতকে জীবিত করেন” বাক্যের তাৎপর্য দাঁড়ায়, প্রতিশোধ গ্রহণ মৃতকে জীবন দানের কার্যকরী ব্যবস্থা। কারণ এরই মাধ্যমে সম্ভাব্য হত্যাকারীকে হত্যাকাণ্ড হইতে প্রতিরোধ ও বিরত করা যাইতে পারে। প্রতিশোধ গ্রহণ মৃতকে জীবন-দানের কার্যকরী পন্থা, এই কথা কুরআনে ২ঃ১৮০ আয়াতেও বলা হইয়াছে। জাহেলিয়াতের যুগে আরবেরা, যে নিহত ব্যক্তির মৃত্যুর প্রতিশোধ গ্রহণ করা হয় নাই, তাহাকেই নিহত বা মৃত মনে করিত এবং যে নিহত ব্যক্তির হত্যার প্রতিশোধ পূরাপুরিভাবে লওয়া হইয়াছে তাহাকে জীবিত জ্ঞান করিত। হারিস-বিন হিজলা নামক প্রসিদ্ধ কবি বলেন, “ইন নাবাশ্তুম মা বাইনা মাল্হাতা ওয়াল সাকীব, ফিহাল আম্ওমাতু ওয়াল আহ্ইয়ায়ু” অর্থাৎ তোমরা যদি মাল্হা ও সাকীবের মধ্যবর্তী স্থানের কবরগুলি খুঁড়িয়া বাহির কর, তাহা হইলে সেখানে তোমরা মৃতকেও দেখিতে পাইবে, জীবিতকেও দেখিতে পাইবে। এখানে জীবিত বলিতে ঐ সকল নিহত ব্যক্তিকে বুঝাইয়াছে, যাহাদের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করা হইয়াছে।