১০৫৮

উম্মী অর্থ- মাতার অংশ স্বরূপ বা অঙ্গীভূত হওয়া বা অধিকারভুক্ত হওয়া অর্থাৎ মায়ের বুকের শিশু যেমন নির্দোষ নিষ্পাপ, এমন ব্যক্তি যে ঐশী গ্রন্থের অধিকারী নহে–বিশেষভাবে একজন আরববাসী; এমন ব্যক্তি যে লিখিতে বা পড়তে জানে না, যাহারা উম্মুল-কুরা অর্থাৎ জনপদ-জননী মক্কার অধিবাসী হিসাবে পরিচিত।

যদি “উম্মী” শব্দ নিরক্ষর (অর্থাৎ যে লিখাপড়া জানে না) অর্থে গ্রহণ করা হয়, তাহা হইলে এই আয়াতের মর্মার্থ দাঁড়ায় যে, যদিও মহানবী (সাঃ) কোন প্রকারের লেখা-পড়াই করেন নাই এবং নিরক্ষর ছিলেন, তথাপি আল্লাহ্‌তা’লা তাঁহাকে অনুগ্রহপূর্বক এমন জ্ঞান প্রদান করিয়াছিলেন যদ্বারা আঁ-হযরত (সাঃ) অত্যন্ত উন্নত জ্ঞানী, সভ্য ও শিক্ষিত অবস্থার লোকদিগকেও পথনির্দেশ ও আলোর সন্ধান দিতে পারিতেন। কতক খৃষ্টান লেখক নবী করীম (সাঃ)-এর নিরক্ষর হওয়ার বাস্তব ঘটনাকে সন্দেহ করার ভান করিয়াছেন। রেভারেণ্ড হোয়েরী তাহার রচিত ‘কুরআন মজীদ’-এর ভাষ্যে মন্তব্য করিয়াছেন—“ইহা কি সম্ভব ছিল যে আলীর সাথে অভিন্ন পরিবারে লালিত পালিত হইয়া আলী পড়িতে ও লিখিতে জানিতেন এবং তিনি অনুরূপ শিক্ষা গ্রহণ করেন নাই? বছরের পর বছর ধরিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ সওদাগর ব্যবসা দক্ষতার সহিত তিনি কি অক্ষর-জ্ঞান ছাড়া পরিচালনা করিয়াছিলেন? তিনি যে লিখিতে ও পড়িতে জানিতেন, ইহা তাঁহার শেষ বছর গুলিতে প্রমাণিত। হাদীসের গ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে যে, তিনি তাঁহার সাহাবা এবং অন্যতম সচীব মুয়াবিয়াকে বলিয়াছিলেনঃ ‘বা’ কে সরলভাবে টান এবং ‘সিন্‌’কে স্পষ্টরূপে বিভক্ত কর ইত্যাদি, এবং তাঁহার বিদায় মুহূর্তে তিনি লেখার সরঞ্জামাদি চাহিয়াছিলেন। কাতেব বা শ্রুতিলেখকদিগকে ব্যবহার তাঁহার লিখিতে জানার বিরুদ্ধে কোন শক্তিশালী যুক্তি নহে, কারণ অনুরূপভাবে কাতেবের ব্যবহার সেই যুগে সাধারণ ছিল, এমনকি জ্ঞাণী পণ্ডিতদিগের মধ্যেও প্রচলিত ছিল।” কিন্তু ইহা একটি দুর্বল যুক্তির অবতারণা যে, যেহেতু নবী করীম (সাঃ), “আলী (রাঃ)-এর সাথে একই পরিবারে লালিত পালিত হইয়াছিলেন সেহেতু তিনি পড়িতে ও লিখিতে জানিতেন,” বা সেই কারণে তাঁহারও পড়া লেখা জানা সম্ভব ছিল। ইহা কেবল রেভারেণ্ড ভদ্রলোকের পক্ষে মহানবী (সাঃ)-এর জীবনের মৌলিক ঘটনা সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচায়ক। হযরত আলী (রাঃ) এবং নবী করীম (সাঃ) একত্রে লালিত পালিত হইতে পারেন না, তাঁহাদের বয়সের অনেক বৎসর ব্যবধান হওয়ার কারণে। আলী (রাঃ) হইতে আঁ-হযরত (সাঃ) উনত্রিশ বৎসরের বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন। হযরত নবী করীম (সাঃ) এবং হযরত আলী (রাঃ)-এর একসঙ্গে শিক্ষাপ্রাপ্ত হওয়ার যুক্তিতে হস্তক্ষেপ না করিলে তাঁহাদের দু’জনের বয়সের বিরাট পার্থক্য দ্বারা স্পষ্ট ও নিশ্চিতরূপে পুর্বাহ্নেই উহা নাকচ হইয়া যায়, হযরত আলীই বরং হযরত নবী আকরাম (সাঃ)-এর গৃহে এবং তাঁহারই নিজের লালনে ও তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত ও শিক্ষাপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন (হিশাম)। আঁ-হযরত (সাঃ) তাঁহার চাচা আবুতালেবের গৃহে প্রতিপালিত হইয়াছিলেন তখন, যখন তিনি অত্যন্ত স্বল্প আয়ের লোক ছিলেন। আবুতালেব জ্ঞান এবং শিক্ষা-দীক্ষার মূল্য উপলব্ধি করিতেন না, এবং তাহার সময়ে তাহাদের অধিকারভুক্ত সম্পত্তি খুব একটা সোপার্জিত সম্পদরূপে বিবেচিত হইত না। অতএব, পবিত্র মহানবী (সাঃ) আবু তালেবের গৃহে নিরক্ষরই রহিয়া গেলেন। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর গৃহে হযরত আলী প্রতিপালিত হইয়াছিলেন, খ্যাতনামা ধনী মহিলা খাদিজা (রাঃ)-এর সাথে তাঁহার বিবাহ হওয়ার কারণে প্রচুর সম্পদ তাঁহার হস্তে ন্যস্ত হইয়াছিল। তিনিও বুঝিয়াছিলেন সুশিক্ষা কিরূপ অমূল্য বস্তু। সুতরাং তাঁহার প্রযত্নে ও মহান প্রভাবাধীনে আলী, সেই যুগের বিবেচনা মতে, স্বাভাবিকরূপে সুশিক্ষিত যুবকে পরিণত হইলেন।

হোয়েরী সাহেবের দ্বিতীয় আপত্তি— যদি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নিরক্ষর হইতেন অর্থাৎ লিখিতে এবং পড়িতে না জানিতেন, তাহা হইলে তিনি প্রকৃতপক্ষে এরূপ খ্যাতিসম্পন্ন ও সফল ব্যবসায়ী হইতে পারিতেন না। তাহার এই ধারণার জন্ম হইয়াছে নবী করীম (সাঃ)-এর যুগের উন্নত কৃতকার্য ব্যবসায়ী সম্পর্কে ভ্রান্ত কল্পনাহেতু। হোয়েরী সাহেব এইরূপ আপত্তি উত্থাপন করিতেন না, যদি তিনি জানিতেন যে, এই বিংশ-শতাব্দীতেও এশিয়ার মধ্যে এমন অনেক উচ্চ স্তরের অত্যন্ত সফল ব্যবসায়ী রহিয়াছে যাহারা, এমন কি, প্রাথমিক শিক্ষাও পান নাই। মহানবী (সাঃ)-এর সময়ে মক্কাতে বিদ্যাশিক্ষা খুব একটা সুনজরে দেখা হইত না। অল্পসংখ্যক লোকেই লিখিতে ও পড়তে জানিত, কিন্তু অনেক লোকই জাঁকালো ও সমৃদ্ধ ব্যবসা সফল ও সার্থকভাবে পরিচালনা করিত। আরবে সেই যুগে ভাল ব্যবসায়ী হওয়ার জন্য বিদ্যা শিক্ষা অপরিহার্য শর্ত বা যোগ্যতা রূপে বিবেচিত হইত না। অধিকন্তু, খাদীজা (রাঃ) নবী করীম (সাঃ)-কে মাইসারাহ নামের এক কৃতদাস দিয়াছিলেন, যে সকল সৌদাগরী সফরে তাঁহার সঙ্গে থাকত এবং সে পড়ালেখা জানিত।এই বাস্তব ঘটনা হোয়েরী সাহেবের মন্তব্যের ভিত্তিকে ভূমিসাৎ করিয়া দেয়।

নবী করীম (সাঃ) মুয়াবিয়াকে “বা” এবং “সিন” সঠিকভাবে লিখিতে যে আদেশ দিয়াছিলেন বলিয়া বর্ণিত হাদীসটি খুব একটা নির্ভরযোগ্য নহে। আব্বাসীয়দের শাসন আমলে উমাইয়াদেরকে ছোট করার জন্য অনেক বর্ণনা হাদীস শরীফে প্রক্ষিপ্ত হইয়াছিল। উক্ত হাদীসে ইহা দেখাইবার প্রচেষ্টা হইয়াছে যে, খ্যাতিমান উমাইয়া বংশের বিশিষ্ট এক প্রধান ব্যক্তি মুয়াবিয়ার মত লোকও নেহায়েত অল্প শিক্ষার মানুষ ছিল, যে নাকি ‘বে’ এবং ‘সীন’-এর মত সহজ অক্ষরকেও শুদ্ধভাবে লিখিতে পারিত না। যাহা হউক, যদি বর্ণিত হাদীসটি নির্ভরযোগ্য বলিয়াও প্রমাণিত হয়, তাহাতেও প্রতিপন্ন হয় না যে, আঁ-হযরত(সাঃ) লিখাপড়া জানিতেন—কেননা অপরের দ্বারা কুরআন লেখাইতে লেখাইতে তিনি এত বেশী অভিজ্ঞ হইয়া উঠিয়াছিলেন যে, আরবী বর্ণের সাধারণ গঠনপ্রণালীর সহিত পরিচিত হইয়া যাওয়া এবং কোন শব্দ সঠিকভাবে লিখিবার নির্দেশ দেওয়া তাঁহার পক্ষে মোটেই অসম্ভব ছিল না।

পবিত্র মহানবী (সাঃ)-এর জীবনের শেষ মুহূর্তে কাগজ কলম আনিতে বলিয়াছিলেন, এই বাস্তব ঘটনাও হোয়েরী সাহেবের অনুমানকে সমর্থন করে না। ঐতিহাসিক সত্য ইহাই যে, যখনই আঁ-হযরত (সাঃ)-এর নিকট কোন আয়াত নাযেল হইত, তখনই তিনি কাগজ-কলম আনিতে বলিতেন এবং তাঁহার লেখকগণের মধ্যে একজনকে নাযেলকৃত আয়াত লিপিবদ্ধ করিবার জন্য নির্দেশ দিতেন। অতএব, হুযুর (সাঃ) কেবল কাগজ কলম আনিতে বলার কারণে ইহা প্রমাণিত হয় না যে, তিনি নিজে লিখিতে পড়িতে জানিতেন, না তাহার তর্কের সমর্থনে উত্থাপিত উক্তিটি অর্থাৎ “পড় তোমার প্রভুর নামে” কোন কিছু প্রমাণ করে। ৯৬ঃ২ আয়াতে ব্যবহৃত আরবী “ইকরা” (পড়) শব্দের অর্থ লিখিত কোন বিষয়কে কেবল পড়া বুঝায় না, ইহা ব্যতীত ইহার অর্থ ইহাও হয় যে, অন্যের নিকট হইতে শুনিয়া পুনরাবৃত্তি করা, পুনঃপুনঃ উচ্চ কণ্ঠে বলা বা পড়া। এতদ্ব্যতীত হাদীস শরীফ হইতে এই ঘটনার প্রতিষ্ঠিত প্রমাণ এই যে, প্রথম ওহী নাযিল হওয়ার সময় জিব্‌রাঈল ফিরিশta “ইকরা” (পড়) শব্দ উচ্চারণ করিয়াছিলেন, কোন লিখা বস্তু নবী করীম (সাঃ)-এর সম্মুখে পড়ার জন্য স্থাপন করেন নাই। তাঁহাকে শুধু বলা হইয়াছিল মৌখিক পুনরাবৃত্তি করিতে যাহা ফিরিশ্‌তা তাঁহার নিকট আবৃত্তি করিয়াছিলেন। অধিকন্তু, কোন কোন খৃষ্টান লেখকের দাবী এই যে, পবিত্র নবী (সাঃ)-পড়া লিখা জানিতেন না, এই ধারণার সূচনা হইয়াছিল, তাঁহার পুনঃ পুনঃ এই দাবীর মাধ্যমে যে, তিনি “নিরক্ষর নবী” (অর্থাৎ উম্মী নবী)। ইহা যেমন বিস্ময়কর তেমনি দুর্বল ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত। ইহা এক আশ্চর্য ব্যাপার যে, তিনি যাহাদের সঙ্গে বৎসরের পর বৎসর দিবা-রাত্র বসবাস করিতেন, এবং যাহারা প্রতিদিন তাঁহাকে পড়িতে ও লিখিতে দেখিয়াছিল, তাহারা আবিষ্কার করিতে পারিল না যে, তিনি “উম্মী” (নিরক্ষর) ছিলেন কি-না, এবং তাহারা এই ভ্রান্ত বিশ্বাসে পরিচালিত হইয়াছিল শুধু তাঁহার পুনঃ পুনঃ এই ঘোষণা বা দাবীর কারণে যে, তিনি উম্মী বা নিরক্ষর ছিলেন!’ হযরত রসূল করীম (সাঃ)-এর শ্রুতিলেখকের ব্যবহার দ্বারা তাঁহার লিখন-বিদ্যা না জানা প্রামাণিত হয় না, কারণ কাতেব ব্যবহারের এইরূপ রীতি সেই যুগে প্রচলিত ছিল, এমনকি সর্বাধিক বিদ্বান লোকদিগের মধ্যেও ছিল। হোয়েরী সাহেবের এই যুক্তিতর্ক আরব এবং ইসলামের ইতিহাস সম্বন্ধে তাঁহার অজ্ঞতার পরিচায়ক। প্রকৃত ঘটনা হইল যে, রসূলে করীম (সাঃ)-এর যামানায় আরবদিগের মধ্যে ‘ওলামা অথবা বিদ্যান পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ এই অর্থে ছিল না যেই অর্থে এই যুগে উক্ত শব্দ গ্রহণ করা হইয়া থাকে, তাহারা শ্রুতিলেখক এবং কারণিক রাখিতেও অভ্যস্থ ছিল না। এমন কোন দৃষ্টান্ত নাই যে কোন একজন আরববাসী কাতেব নিযুক্ত করিয়াছিল। বিদ্বান-পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গের সর্বসম্মতিক্রমে পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত ঐক্যমত ইহাই যে, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত পড়িতে এবং লিখিতে জানিতেন না। এই বিষয়ে কুরআন করীমে স্পষ্ট বর্ণিত আছে যে, এই নবী (সাঃ) নিরক্ষর ছিলেন, অন্ততঃ আল্লাহ্‌তা’লার প্রেরিত নবীরূপে দাবী অবধি (২৯ঃ৪৯)। যাহা হউক জীবনের শেষ দিকে তিনি কিছু কিছু শব্দের পাঠোদ্ধার করিতে শিখিয়াছিলেন মাত্র।