এই আয়াত ধর্মের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়ের উপর কিছু আলোকপাত করিয়াছে— জাগতিক চর্মচক্ষে কাহারো পক্ষে আল্লাহ্তা’লাকে দেখা সম্ভব নহে। উক্ত আয়াত হইতে এহেন মতের কোন সমর্থন পাওয়া যায় না যে, জড় চক্ষুতে আল্লাহ্তা’লা দষ্টিগোচর হন (৬ঃ১০৪)। আল্লাহ্কে দেখাতো দূরে থাকুক, ভৌতিক চোখে ফিরিশ্তাগণকেও দেখা যায় না, আমরা কেবল প্রকাশিত বিষয়াদীর মধ্যে তাহাদের অভিব্যক্তি দেখিতে পাই, অনুরূপভাবে আল্লাহ্র প্রকাশিত গুণাবলী সমূহ দেখা যায়, স্বয়ং আল্লাহকে নহে। অতএব, ইহা এক অচিন্ত্যণীয় ব্যাপার যে, মূসা (আঃ)-এর মত আল্লাহ্র এক মহান নবী আল্লাহ্তা’লার সিফ্ত সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থাকা সত্বেও অসম্ভব বা অবাস্তব আকাঙ্খা করিয়াছিলেন। মূসা (আঃ) জানতেন যে, তিনি শুধু আল্লাহ্র নিদর্শন দেখিতে পারেন, এবং স্বয়ং আল্লাহ্তা’লাকে নহে। কিন্তু তিনি মিদিয়ান হইতে মিশর যাওয়ার পথে পাহাড়ের দিকে যে অগ্নি (২৮ঃ৩০) দেখিয়াছিলেন উহার মধ্যে আল্লাহ্তা’লার নিদর্শন প্রকাশিত হইয়াছিল। তবে মূসা (আঃ) যে আল্লাহ্তা’লাকে দেখার জন্য অনুরোধ করিয়াছিলেন এই বলিয়া “হে আমার প্রভু! তুমি আমাকে তোমার দর্শন দান কর” কথাগুলির দ্বারা কি বুঝাইয়াছিলেন? এই প্রার্থনা মনে হয় আল্লাহ্তা’লার সিফ্তের পূর্ণ প্রকাশ যাহা পরবর্তী সময়ে ইসলামের পবিত্র নবী করীম (সাঃ)-এর সত্তার মধ্যে প্রকাশিত হওয়ার ছিল, সেইদিকে ইশারা করিতেছে। হযরত মূসা (আঃ)-কে পূর্বেই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইয়াছিল যে, ইসরাঈলীদের ভাইদের মধ্য হইতে এক মহান নবীর আবির্ভাব হইবে যাহার মূখে আল্লাহ্তা’লা স্বীয় বাণী দিবেন (দ্বিতীয় বিবরণ-১৮ঃ ১৮-২২)। এই ভবিষ্যদ্বাণীতে মূসা (আঃ)-এর নিকট আল্লাহ্তা’লা যেরূপ প্রকাশিত হইয়াছিলেন, উহা হইতে অধিক ও পূর্ণতর উজ্জ্বলরূপে প্রকাশিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি নিহিত ছিল। এই কারণে স্বভাবতঃই মূসা (আঃ) দেখিবার জন্য উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিয়াছিলেন যে, কেমন সেই প্রতিশ্রুত মহিমাময় ও সুন্দর জ্যোতিঃ, যেরূপে আল্লাহ্তা’লা ভবিষ্যতে প্রকাশিত হইবেন। হযরত মূসা (আঃ) সেই গৌরবোজ্জ্বল ও মহিমাময় রূপের এক ঝলক দেখিতে চাহিয়াছিলেন। তাঁহাকে বলা হইয়াছিল যে, আল্লাহ্তা’লার সেই গৌরবোদ্দীপ্ত মহান রূপের প্রকাশ বহন করিবার ক্ষমতা তাঁহার মধ্যে নাই; তাঁহার হৃদয় উহা গ্রহণ বা সহ্য করিতে পারিত না এবং এই জন্যই আল্লাহ্তা’লা তাঁহার প্রকাশের জন্য পাহাড়কে পসন্দ করিয়াছিলেন। পাহাড় প্রচণ্ডভাবে কাঁপিয়া উঠিল এবং এরূপ মনে হইয়াছিল যেন চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া ভাঙ্গিয়া পড়িল, এবং হযরত মূসা (আঃ) কম্পনের প্রভাবে অভিভূত হইয়া অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া গেলেন। এইভাবে তাঁহাকে স্পষ্টরূপে উপলদ্ধি করান হইয়াছিল যে, তিনি এত উচ্চ মার্গের আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্য বা মহত্ত্ব অর্জন করেন নাই যাহার ফলে তিনি সেই ঐশী-নিদর্শনের প্রকাশস্থলে পরিণত হইতে পারেন, যাহা দেখার জন্য তিনি আল্লাহ্তা’লার নিকট অনুরোধ করিয়াছিলেন। এই বিশেষ অধিকার একমাত্র একজনের জন্য রক্ষিত ছিল যিনি হযরত মূসা (আঃ) অপেক্ষা অনেক বেশী মর্যাদাপূর্ণ, তিনি হইতেছেন সৃষ্টির সেরা মানবকূল শিরোমণি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। হযরত মূসা (আঃ)-এর আবেদন এই প্রেক্ষিতেও হইতে পারে যে, ইহুদী প্রধানগণ নগ্নচোখে আল্লাহকে দেখার জন্য দাবী জানাইয়া চাপ দিতেছিল (২ঃ৫৬)। তাঁহার উক্ত অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতা হইতে মূসা (আঃ) উপলব্ধি করিয়াছিলেন যে, তাঁহার আবেদন সময়োপযোগী ছিল না। সুতরাং মূসা (আঃ)স্বতঃস্ফুর্তভাবে উচ্চঃস্বরে ঘোষণা করিয়াছিলেন “আমি তোমার দিকে প্রত্যাবর্তন করি এবং আমি বিশ্বাস আনয়নকারীদের মধ্যে প্রথম” যাহার মর্ম এই যে, তিনি উপলব্ধি করিতে পারিয়াছিলেন যে, মহান ঐশী মর্যাদাপূর্ণ গৌরবময় গুণের বিকাশস্থল যাহা প্রতিশ্রুত মহানবী (সাঃ)-এর হৃদয়ে হওয়ার ছিল, উহা ধারণ করার মত ক্ষমতা মূসা (আঃ)-এর ছিল না, এবং তিনিই প্রথম ঈমান আনিয়াছিলেন সেই মহানবীর উচ্চতম আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি যেই উচ্চ মোকামে তাঁহার পৌঁছা অবধারিত ছিল। হযরত মহানবী (সাঃ)-এর প্রতি মূসা (আঃ)-এর এই বিশ্বাস সম্বন্ধে ৪৬ঃ১১ আয়াতেও উল্লেখ রহিয়াছে।