১০২৩

পবিত্র কুরআন করীম মূসা (আঃ)-এর লাঠিকে সর্পে পরিবর্তিত করার বর্ণনা করিতে গিয়া তিনটি ভিন্ন ভিন্ন শব্দের ব্যবহার করিয়াছে, যথাঃ-২০ঃ২১ আয়াতে “হাইয়াতুন”, ২৭ঃ১১ ও ২৮ঃ৩২ আয়াতদ্বয়ে “জা-ন্ন্‌” এবং ২৬ঃ৩৩ ও তফসীরাধীন আয়াতসমূহে “সু’বান”। প্রথমোক্ত শব্দ সর্বপ্রকার সাপের জন্য সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়। দ্বিতীয় শব্দটি ছোট সাপ বুঝায়। তৃতীয় ‘সু’বান’ শব্দ মোটা ও দীর্ঘ (অজগর) সর্প নির্দেশ করে। এইরূপে কুরআনের পৃথক স্থানে ভিন্ন ভিন্ন শব্দের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং প্রত্যক্ষরূপে বিশেষ বা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ব্যবহৃত হয়। সাপের তরিৎগতি বুঝাইবার জন্য “জা-ন্ন্‌” শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে এবং ইহার বিরাটকায় হওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি হইতে “সুবান” ব্যবহৃত হইয়াছে। যেখানে যষ্টির কেবল সাপের রূপ নেওয়ার ঘটনাটি উল্লেখ হইয়াছে, সেখানে হাইয়াতুন ব্যবহৃত হইয়াছে, কিন্তু হযরত মূসা (আঃ)-এর একা উপস্থিতিতে কেবল যখন যষ্টি সর্পে রূপান্তরিত হওয়ার কথা বলা হইয়াছে যেখানে ‘জা-ন্ন্‌’ শব্দ আসিয়াছে, যাহার অর্থ ছোট সাপ। কিন্তু যেস্থানে ফেরাউন, যাদুকর এবং জনসাধারণের সম্মুখে লাঠির সাপে রূপ নেওয়ার বিস্বয়কর ব্যাপার প্রদর্শিত হয়, সেস্থানে “সুবান” শব্দ ব্যবহার করা হইয়াছে। ভিন্ন ভিন্ন উপলক্ষ্যে এই সকল পৃথক শব্দের মমার্থ বিভিন্ন। “হাইয়াতুন” শব্দের মর্মার্থ হইল যে, কার্যতঃ ইস্‌রাঈলীরা একটি মৃত জাতিতে পরিণত হইয়াছিল, (‘আসা’ শব্দের দ্বারা সম্প্রদায় বুঝায়) যাহারা হযরত মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে এক তেজোদীপ্ত নূতন জীবন লাভ করিবে (ইহাই মূল- হাইয়্যা শব্দের ব্যাখ্যা)। ‘জা-ন্ন্‌’ (ছোট দ্রুতগতি সম্পন্ন সর্প) শব্দের মর্মার্থ হইল যে, নগণ্য এবং অধঃপতিত এক সম্প্রদায় হইতে তাহারা (ইস্‌রাঈলীগণ) অতি দ্রুত উন্নতি করিবে এবং ফেরাউন ও তাহার জাতির জন্য এক ‘সু’বান’ (বিরাট ও বিশালায়তন সর্প) অর্থাৎ অজগরে পরিণত হইবে, অর্থাৎ উহারা (ইস্‌রাঈলীগণ) তাহাদের (ফেরাউনের) ধ্বংসের উপায় ও কারণ হইবে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, অন্যান্য বিস্ময়কর বিষয়ের মতই আল্লাহ্‌তা’লার নবী কর্তৃক প্রদর্শিত এই অলৌকিক ঘটনা বা মোজেযা প্রাকৃতিক নিয়ম বিরুদ্ধ নহে। যদি কোন ব্যাপার বাস্তবে ঘটিয়াছে বলিয়া প্রমাণিত হয়, তাহা হইলে উহাকে সত্য বলিয়া অবশ্যই গ্রহণ করিতে হইবে, যদিও প্রাকৃতিক নিয়ম সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞানানুযায়ী উহা আমাদের নিকট ব্যাখ্যাসাধ্য অথবা বোধগম্য নহে। প্রকৃতির নিয়ম সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান, যত বেশী হউক না কেন, অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। অতএব আমাদের সীমাবদ্ধ এবং অপূর্ণ জ্ঞানের ভিত্তিতে বাস্তবে সংঘটিত কোন ঘটনাকে আমরা কোনক্রমেই অস্বীকার করিতে পারি না। এতদ্ব্যতীত হযরত মূসা (আঃ) কর্তৃক প্রদর্শিত অলৌকিক ঘটনা বা মোজেযা জনসাধারণ্যে প্রচলিত ধারণানুযায়ী ঘটে নাই। আল্লাহ্‌তা’লার নবীগণের বিস্ময়কর নিদর্শন প্রকাশ ভোজবাজীর হস্ত-কৌশল বা ম্যাজিক নহে। এইরূপ নিদর্শনের উদ্দেশ্য হইল এক মহান নৈতিক বা আধ্যাত্মিক অবস্থার সৃষ্টি করা যাহার ফলে আল্লাহ্‌তা’লার প্রতি নিশ্চিত বিশ্বাস সৃষ্টি হয় ধর্মানুরাগের চেতনা এবং আল্লাহ্‌ভীতি তাহাদের অন্তরে জন্ম নেয় যাহারা এই সকল নিদর্শনসমূহ প্রত্যক্ষ করে। যদি যষ্টি প্রকৃতই সর্পাকার ধারণ করিয়া থাকিত, তাহা হইলে উহা একজন নবীর অলৌকিক নিদর্শন অপেক্ষা যাদুকরের ম্যাজিক বা ভোজবাজীই মনে হইত। এই বিস্ময়কর ঘটনা সম্পর্কে বাইবেল যাহাই বলুক, কুরআন করীম এই ধারণা বা মতের সমর্থন করে না যে, লাঠি বাস্তবে সত্য সত্যই জীবন্ত সর্পের আকার ধারণ করিয়াছিল। এইরূপে কোন ব্যাপার ঘটিয়াছিল বলিয়া প্রতীয়মান হয় না। লাঠিটি দেখিতে কেবল দ্রুতগতিসম্পন্ন সাপের মত মনে হইয়াছিল। অলৌকিক ঘটনা এক প্রকার কাশ্‌ফ (দিব্যদৃষ্টি) যাহার মধ্যে দর্শকের দৃষ্টিকে আল্লাহ্ হয়ত বিশেষ নিয়ন্ত্রণ দ্বারা এমন করিয়াছিলেন যে, তাহারা যষ্টিকে সাপের আকারে দেখিয়াছিল অথবা লাঠির নিজস্ব রূপ এমন করিয়া দিয়াছিলেন যে উহা সাপের মত দেখাইয়াছিল; এই কাশ্‌ফে ফেরাউন তাহার পরিষদবর্গ এবং যাদুকরগণ হযরত মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে সহদর্শকের স্থান পাইয়াছিল। যষ্টি যষ্টিই রহিয়াছিল, মূসা (আঃ) এবং অন্যান্যদের নিকট উহা কেবল সাপের মত দেখাইতেছিল। ইহা সার্বজনীন বিস্ময়কর এক আধ্যাত্মিক ব্যাপার যে, কাশ্‌ফে মানুষ যখন জড়দেহের উর্ধ্বে উন্নীত হয় এবং ক্ষণকালের জন্য আধ্যাত্মিক গগণমণ্ডলে পরিভ্রমণ করিয়া বেড়ায়, তখন সে এমন ব্যাপার ঘটিতে দেখে যাহা তাহার জ্ঞানের সীমার বাহিরে এবং তাহার জড়চক্ষে সম্পূর্ণ অদৃশ্য। হযরত মূসা (আঃ)-এর লাঠি সর্পরূপে দেখিতে পাওয়ার ঘটনা এইরূপ এক অলৌকিত আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা। একইভাবে এইরূপ বিস্বয়কর আধ্যাত্মিক ঘটনা ঘটিয়াছিল আঁ-হযরত (সাঃ)-এর সময়ে যখন চন্দ্রকে দিখণ্ডিত দেখা গিয়াছিল, উহা না কেবল নবী করীম (সাঃ) দেখিয়াছিলেন বরং তাঁহার অনুসারীগণের মধ্যেও কয়েকজন এবং বিরুদ্ধবাদীগণও ইহা (চন্দ্র) বিভক্ত বা দিখণ্ডিত হওয়া দেখিতে পাইয়াছিলেন (বুখারী, কিতাবুত তফসীর)। রসূলে করীম (সাঃ)-এর হাদীসে বর্ণিত আছে যে, একদিন তাহার সাহাবাগণ (রাঃ) যাহারা তাঁহার সঙ্গে বসা ছিলেন সেই সময়ে তাহারা জিব্‌রাঈলকে দেখিতে পাইয়াছিলেন যাহাকে নবী করীম (সাঃ) পুনঃ পুনঃ কাশফে সাক্ষাৎ পাইয়া থাকিতেন (বুখারী, কিতাবুল ঈমান)। একই ভাবে বদরের যুদ্ধে কাফেরদিগের মধ্যেও অনেকে ফিরিশ্‌তা দেখিতে পাইয়াছিলেন (জারীর, ৬ষ্ঠ, ৪৭ পৃঃ)। এইরূপ অন্য এক ঘটনা ঘটিয়াছিল যখন মুসলিম সেনাবাহিনী খ্যাতনামা সেনাপতি সারিয়াহ্ (রাঃ)-এর নিয়ন্ত্রণে ইরাকে শত্রুসেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতেছিল, সেই সময় দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রাঃ) মদীনায় শুক্রবারে জুমুয়ার খুতবা দিতেছিলেন, তখন তিনি দিব্যদর্শনে অর্থাৎ কাশ্‌ফে দেখিতে পাইলেন যে, মুসলমান সৈন্যগণ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ শত্রুসেনার নিকট কাবু হইয়া যাইতেছিল এবং এক সর্বনাশা পরাজয় আসন্ন। অবিলম্বে তিনি (হযরত ওমর-রাঃ) আকস্মিকভাবে খুতবা দেওয়া বন্ধ রাখিয়া, মেহরাবের উপর হইতে উচ্চঃস্বরে বলিয়া উঠিলেনঃ “ওহে সারিয়াহ্ পাহাড়ের দিকে যাও, পাহাড়ের দিকে যাও” অর্থাৎ নিকটবর্তী পাহাড়ে আশ্রয় গ্রহণ কর। শত শত মাইল দূরে যুদ্ধ ক্ষেত্রের কানফাটা হৈ চৈ শব্দের মধ্যেও সেনাপতি সারিয়াহ্ হযরত ওমর (রাঃ)-এর আওয়াজ শুনিতে পাইয়াছিলেন এবং খলীফার নির্দেশ পালন করিয়াছিলেন এবং মুসলমান সৈন্যরা নিশ্চিত ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষা পাইয়াছিলেন (খামিস, ২য়, ৩৭০ পৃঃ)। হযরত মূসা (আঃ)-এর অলৌকিক নিদর্শন এক বিশেষ গুরুত্ব বহন করিত। উহাকে এইভাবে ব্যাখ্যা করা যাইতে পারে। আল্লাহ্‌তা’লা হযরত মূসা (আঃ)-কে তাঁহার হাতের যষ্টি মাটিতে নিক্ষেপ করিতে বলিলেন, উহা তখন তাঁহার নিকট সাপের মত মনে হইয়াছিল, এবং যখন আল্লাহ্‌তা’লার আদেশে তিনি উহা হাতে তুলিয়া নিলেন, উহা তখন এক কাষ্ঠখণ্ড ব্যতীত অন্য কিছুই রহিল না। এখন কাশ্‌ফ বা স্বপ্নের ভাষায় সর্প হইল শত্রুর প্রতীক এবং লাঠি হইল সম্প্রদায় বা গোষ্ঠি বা দলের প্রতীক (তাতিরূল আনাম)। এইরূপে উক্ত কাশ্‌ফের সাহায্যে আল্লাহ্‌তা’লা মূসা (আঃ)-কে জানাইয়াছিলেন যে, যদি তিনি তাঁহার সম্প্রদায়ের লোকদিগকে ছাড়িয়া দেন বা ত্যাগ করেন তাহা হইলে তাহারা সর্পের ন্যায় অধঃপতিত হইয়া যাইবে। কিন্তু যদি তিনি তাহাদিগকে তাঁহার তত্বাবধানে প্রতিপালন করেন তাহা হইলে তাহারা সৎ ও আল্লাহ্-ভীরু লোকের এক শক্তিশালী এবং সুশৃংখল জাতিতে পরিণত হইবে।